এম ইউ বাহাদুর….
আজ ২৩ ডিসেম্বর শহীদ আবু নাছের ভাইয়ের ২২তম শাহাদাত বার্ষিকী।
শহীদ হাফেজ আবু নাছের ভাইয়ের পরিচিতি ও ঘঠনার বিবরনঃ
২৫ নভেম্বর ১৯৭২ – ২৩ ডিসেম্বর ১৯৯৭
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির
শাহাদাতের ঘটনা
‘শহীদ হাফেজ আবু নাছেরের মৃত্যুতে দেশ ও জাতি হারিয়েছে এক প্রতিশ্রুতিশীল নাগরিক আর আমি হারিয়েছি আমার বাগানের শ্রেষ্ঠ গোলাপটিকে। বাগানের মালী কক্সবাজার সরকারি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর সমীর কুমার চক্রবর্তী সদর হাসপাতালে আবু নাছেরের লাশ দেখার পর আবেগাপ্লুত হয়ে প্রিয়জন হারানোর বেদনার অনুভূতি এভাবেই ব্যক্ত করেন। শহীদ হাফেজ আবু নাছের দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পট উখিয়ার ইনানীতে ১৯৭৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তাঁর পিতা একজন আলেমে দ্বীন এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় মাওলানা আব্দুস সালাম। পিতা মাতার আদর যত্ন এবং ভাই বোনদের মায়া মমতায় শিশুটি গড়ে উঠে সুন্দর সুঠাম ও আকর্ষণীয় চরিত্রের। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে তার মাঝে সৃষ্টি হয় মহান আল্লাহর একনিষ্ঠতা এবং খোদাভীরুতা। ভাইবোনদের সাথে সমুদ্র সৈকতে খেলাধুলার সাথে সাথে কিশোর নাছের হয়ে উঠে সাগরের ন্যায় বিশাল হৃদয়, ঢেউয়ের প্রচণ্ডতায় বলিষ্ঠ সাহসের অধিকারী। কোরআন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অগ্রসৈনিক কোরঅনের আলোকেই যাতে গড়ে উঠতে পারে সে জন্য পিতা তাকে ভর্তি করান হাফেজিয়া মাদ্রাসায়। পুরো কোরআন শরীফ আত্মস্থ করে কোরআন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যোগ দেয়ার জন্যে একাডেমিক পড়ালেখার পাশাপাশি ভর্তি হয় ইসলামী ছাত্রশিবিরে।
ঘটনার বিবরণ
তার অনুপম চরিত্রে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে সংগঠনের সর্বস্তরের কর্মী-দায়িত্বশীলদের মাঝে। ১৯৯৬ সালে কক্সবাজার শহর শাখার সভাপতি থাকাকালে প্রতিটি অলিতে গলিতে, বাসা বাড়িতে পদচারণায় যেন তাকে সর্বস্তরের মানুষের প্রিয়জনে পরিণত করেছে। প্রশংসায় মহান আল্লাহর কাছে মাথা নুহ্য হয়ে যায়। আল্লাহ তার মনোনীত বান্দাদের এভাবেই ব্যতিক্রম গুণাবলী দিয়ে গুণান্বিত করেন যা মানুষ কখনো ভুলতে পারে না। দায়িত্বের খাতিরে যখন আমরা বিভিন্ন এলাকায় যাই মনে হয় পরিচিত সকল ছাত্র যুবক ও শুভাকাঙ্খীরা এমনকি প্রত্যেকটি বাসা বাড়ি থেকেই একটি কথা শোনা যায় ‘ আবু নাছের ভাই এখানে আসতে, সালাম দিতেন, আমরা কিছু বললে তিনি শুধু হাসতেন।’
এভাবেই তার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা সদালাপ, আচার ব্যবহার, মেধা, প্রজ্ঞা এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা তাকে কক্সবাজারের ইসলামী আন্দোলনের একজন প্রথম সারির নেতৃত্বের আসনের আসীন করা হয়। ১৯৯৭ সালে কক্সবাজার সরকারি কলেজের স্নাতক ১ম বর্ষের যখন ভর্তি হয় তখন সব শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারীরা যেন দীর্ঘদিন পর তাদের প্রিয় নেতা খুঁজে পায়। শিবিরের কলেজ শাখা সভাপতি নির্বাচিত হন। যুগপৎভাবে আঞ্জাম দিতে থাকে সংগঠন এবং ছাত্রসংসদের কার্যক্রম।
মেধা, পরিশ্রমপ্রিয়তা সকলের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার, শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং অধিকার আদায়ের কৌশল তাকে ক্যাম্পাসে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। ৯৭ সালের নবীন বরণে প্রদত্ত স্বাগত বক্তব্যে তিনি যেন এ আহবান রেখে গেলেন, হে নবীন ভাই ও বোনেরা শোনো! পৃথিবীর নির্যাতিত আবালবৃদ্ধবনিতার আহাজারি জাগ্রত হও, অন্যায়, অত্যাচার জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলো। খোদার জমিনে খোদার দেয়া জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রামে অবতীর্ণ হও।
ঈমানের বলে বলীয়ান এই বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বও বাতিলের সহ্য হয়নি। পরিকল্পনা নিল এই প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে হবে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা বেছে নিল ২৩ ডিসেম্বর।
সেদিন যা ঘটেছিল
২৩ ডিসেম্বর ’৯৭। কক্সবাজারের ইতিহাসে বর্বর ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দিন। সেদিন ছিল কক্সবাজারের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়ন ঝিলংজা ইউনিয়নবাসী আহূত হরতালের দিন। সকাল সন্ধ্যা হরতাল, ভোর থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলছিল হরতাল। ঝিলংজা তথা কক্সবাজার পৌরসভার সাধারণ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করছিল। দোকান-পাট, স্কুল কলেজ, খাবার হোটেল এমনকি ছোট পানের দোকান পর্যন্ত বন্ধ ছিল। সকল প্রকার যানবাহন এমনকি সাইকেল পর্যন্ত সেদিন চলেনি। কক্সবাজারের ইতিহাসে ঐতিহাসিক ও স্বতঃস্ফূর্ত এই হরতাল চলাকালে সংঘটিত হয় এক কলঙ্কময় ঘটনা। সময় আনুমানিক সকাল ১১.০০টা। সাধারণ জনগণ, ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, দোকানদার এমনকি পর্যটক সবাই ছিল রাজপথে। হঠাৎ করে বিনা উস্কানিতে সাধারণ জনতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল হায়েনার দল। ম্যাজিস্ট্রেট দীপক চক্রবর্তীও নেতৃত্বে পুলিশ রাইফেল ও এস এল আর নিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করল।
সাধারণ মানুষ আতংক ভয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকল। সবাই পালিয়ে গেল অলি গলিতে। কিন্তু ‘উন্মত্ত পুলিশ বাহিনী মেতে উঠল রক্তের হলি খেলায়। শতাধিক পুলশ দলে দলে বিভক্ত হয়ে কৃষি অফিস রোড, পানবাজার রোড, ফায়ার ব্রিগেড রোড, বাজার ঘাটা মসজিদ রোড, হাসপাতাল রোড, প্রতিটি অলিতে গলিতে পালিয়ে আশ্রয় নেয়া সাধারণ জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। পুলিশের গুলিতে কৃষি অফিস রোডে কপালে বুলেটবিদ্ধ হয়ে শাহাদাৎ বরণ করেন কক্সবাজার সরকারি কলেজ শাখার সভাপতি হাফেজ মো. আবু নাছের এবং ফায়ার ব্রিগেড রোডে বুলেটবিদ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ করেন স্কুলছাত্র কিশোর শিবিরকর্মী মুর্তজা হাসান। বুলেটবিদ্ধ হয়ে পান বাজার রোডে আহত হন শিবিরের জেলা সেক্রেটারি জইরুল ইসলাম টিপু, হোটেল শ্রমিক আবদুল মান্নান, বুলেটে স্কাউট লিডার তপন শর্মার মুখের এক পাশ উড়ে গেল। বাজার ঘাটা মসজিদ রোডে ডান পায়ে গুলি বিদ্ধ হয়ে আহত হন ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম। বাম পায়ে বুলেট বিদ্ধ হয় দোকান কর্মচারী নূর আহমাদ, কিশোর ব্যবসায়ী জামাল উদ্দীনের বাম পায়ে নিষ্ঠুর বুলেট আঘাত হানতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। এভাবে শতাধিক ছাত্র, শ্রমিক, পর্যটক, জনতা বুলেটবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে প্রধান সড়ক ও বিভিন্ন গলিতে। রক্তাক্ত হয় কক্সবাজার, ঘৃণ্য ইতিহাস যোগ হয় কক্সবাজারের ইতিহাসে।