শিপন পাল :
সংকটাবস্থার কারণেই কক্সবাজার পর্যটন শিল্প বিকাশে বাঁধাগ্রস্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বীচ কার্ণিভাল, ৩১ ডিসেম্বর, ঈদ-উদ-ফিতরের ছুটি, ঈদ-উল-আযহার ছুটি, পহেলা বৈশাখ সহ সংশ্লিষ্ট দিবসের ছুটির সময় পর্যটকে ভিড় জমে কক্সবাজারে। দেশবিদেশ থেকে আসা পর্যটকরা কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ছুটে আসলেও অনেক কিছুরই সংকট বোধ করে প্রতিনিয়ত।
কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেল থাকা ও খাবারের মূল্য নিয়ন্ত্রণ চরম পর্যায়ে। পাশাপাশি রয়েছে কক্সবাজার সৈকতে পর্যন্ত পার্কিং স্থানের অভাব। একইভাবে নয়নাভিরাম অবলোকনে ছুটে আসা পর্যকটদের জন্য নেই নির্দিষ্ট কোন পিকনিক স্পট। অন্যদিকে সৈকত ছাড়া পর্যাপ্ত পর্যটন ভিলেজ না থাকায় কক্সবাজার বিমুখ হচ্ছে দেশিবিদেশী পর্যটকরা। এসব সংকাটবস্থার নিরসনের দূর্বলতার কারণে পিছিয়ে পড়ছে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প।
হাতিরঝিল থেকে বেড়াতে আসা পর্যটক ইলহাজ তুতুল নামে এক পর্যটক বলেন, বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকত নগরী কক্সবাজারে বলতে গেলে আবাসিক হোটেল ব্যবস্থায় ও খাবারের মূল্য নিয়ন্ত্রণের অভাব রয়েছে। সৈকতে অবস্থিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভ্রাম্যমান দোকানী থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের যেকোন খাবারের মূল্য লাগামহীন। সামান্য একটি বাচ্চাদের চিপ্্স এর মূল্যও ৫ টাকা বৃদ্ধি। খাবারের দোকানে ঢুকলে গলা দিয়ে খাবার নামে না। খাবারের মূল্য নিয়ন্ত্রণের অভাবে কক্সবাজার এখন সার্বজনীন পর্যটকদের জন্য গড়ে উঠতে পারছে না। খাবারের ব্যয় বহুলতার কারণে দেশের মধ্যবিত্ত পর্যটকরা কক্সবাজার বেড়ানোর সাহস করতে পারে না। প্রশাসনিকভাবে যদি হোটেল ও খাবারের মূল্য নিয়ন্ত্রণ সংকটের বিষয়টি নিয়ে নজরদারি বৃদ্ধি করে তাহলে বৎসরের যেকোন সময়ে কক্সবাজারে পর্যটক বৃদ্ধি পাবে।
বেড়াতে আসা ঢাকার গোবিন্দ প্রামাণিকের মতে, কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটকদের জন্য আলাদা কোন পার্কিং ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। যেটা বর্তমান পর্যটন ব্যবস্থায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সৈকতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, যেসব পয়েন্ট দিয়ে পর্যটকরা সৈকতে নামবে ওই পয়েন্টের সড়কের উপরেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির প্রাইভেট কার রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্যান্য সব লোকাল সিএনজি, টমটমে ভরপুর। এসব অব্যবস্থাপনায় রাখা গাড়ি ও লোকাল ড্রাইভারের কলরব লেগে আছে। পর্যটকদের গাড়ী পার্কিং করার জন্য নির্দিষ্ট কোন পার্কিং স্থান না থাকায় বেড়ানোর সময়ও গাড়ি নিয়ে মাথাব্যাথা থেকে যায়। এজন্য পর্যটন সংশ্লিষ্টদের সৈকতে পর্যাপ্ত পার্কিং স্থানের অভাবটি পুরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
কক্সবাজারের দুর্বলতার কথা বলতে গিয়ে ঝালকাঠির মুনতাহির বলেন, হোটেল ও খাবারের মূল্য নিয়ন্ত্রণের অভাব, সৈকতে পর্যাপ্ত পার্কিং স্থানের অভাবতো রয়েছেই। পাশাপাশি কক্সবাজারের মতো পর্যটন শহরে সংকট বিরাজ করছে পিকনিক স্পটের। পর্যাপ্ত পিকনিক স্পট না থাকায় প্রতি বৎসর হিমশিম খেতে হয়। মৌসুমের সময় প্রতি বৎসর আমরা কক্সবাজারে আসি পিকনিকে। কিন্তু পিকনিকে নিয়ে আসা গাড়িগুলো রাখতে সীমাহিন দূর্ভোগের শিকার হতে হয়। কক্সবাজারে সৈকতে, হিমছড়ি, ইনানীসহ পুরো কক্সবাজার জুড়ে একই অবস্থা বিরাজ করে। নির্দিষ্ট একটি স্পট চিহ্নিত করে পিকনিকের গাড়ীগুলো রাখার ব্যবস্থা করলে পর্যাপ্ত পিকনিক স্পটের অভাবটি পুরণ করা যেত।
ফরিদপুরের নাদির হোসেন জানান, কক্সবাজারে বৃহত্তর সমুদ্র সৈকত ছাড়া তেমন কিছু বৃহৎ আকারে গড়ে উঠতে সক্ষম হয়নি। অথচ কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের দর্শণীয় স্থানে কক্সবাজারে মৎস্য অবতরণ ও পাইকারী মৎস্য বাজার, বড়ঘোপ সমুদ্র সৈকত, মাতামুহুরী নদী, কানা রাজার সুড়ঙ্গ, আদিনাথ মন্দির, বরইতলী মৎস্যখামার এর মতো আরও দর্শণীয় স্থান উল্লেখ থাকলেও অধিকাংশ এখন বিলুপ্তির পথে। মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির ও কুতুবদিয়ার বড়ঘোপ সমুদ্র সৈকত যাতায়াত অনুপযোগীর কারণে দেশবিদেশের পর্যটকদের জন্য বিচ্ছিন্ন। কক্সবাজারের প্রতিটি উপজেলায় পর্যটকরা বেড়ানোর জন্য আকর্ষণীয় স্থান থাকলেও পরিকল্পনার অভাবে তা প্রসারিত হয়ে উঠেনি। পর্যাপ্ত পর্যটন ভিলেজের অভাব থেকে কক্সবাজারকে মুক্ত করতে পারলে পর্যটন নগরী কক্সবাজার যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাবে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশেরও সময় এসেছে দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বৈচিত্র্যে ভরা ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, উল্লেখযোগ্য সেবা, উদ্যোগ ও পণ্যগুলোকে জেলা-ভিত্তিক ব্র্যান্ডিং করে দেশে-বিদেশে তুলে ধরার। একটি জেলার সর্বস্তরের মানুষের আশা-আকাঙ্খা, ঐতিহ্য, গৌরবকে দেশে-বিদেশে ভাস্বর করে তোলার লক্ষ্যে সকলের একাত্ম হয়ে কাজ করার জন্য জেলা-ব্র্যান্ডিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ উদ্দেশ্যে কক্সবাজার জেলার জেলা-ব্র্যান্ডিং পর্যটণ শিল্পের বিকাশ ও সমৃদ্ধির উপর ভিত্তি করে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করার প্রয়াস ও কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
এদিকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সার্বিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সুবিধার্থে প্রাথমিকভাবে পর্যটনের দূর্বলতা চিহ্নিত করে তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে হোটেল ও খাবারের মূল্য নিয়ন্ত্রণের অভাব, সৈকতে পর্যাপ্ত পার্কিং স্থানের অভাব, পর্যাপ্ত পিকনিক স্পটের অভাব ও পর্যাপ্ত পর্যটন ভিলেজের অভাবের বিষয়টি উঠে এসেছে।
কক্সবাজার সোসাইটির সভাপতি কমরেড গিয়াস উদ্দিন বলেন, কক্সবাজারে বেড়াতে আসা এবং স্থানীয়দের জন্য হোটেলে খাবারের মূল্য নিয়ন্ত্রণ অভাবটি দীর্ঘদিনের। এর কারণে দেশিবিদেশী পর্যটকদের কাছে কক্সবাজারের ঐতিহ্যকে ম্লান করেছে। একইভাবে কক্সবাজার সৈকত সহ আশেপাশের স্পটগুলোতে পর্যাপ্ত পার্কিং স্থানের অভাব রয়েছে। পর্যটন মৌসুমের সময় জেলা বেড়াতে আসা পর্যটকদের হয়রানীর শিকার হতে হয় পর্যাপ্ত পিকনিক স্পটের অভাবে। তিনি বলেন, কক্সবাজারের ৮টি উপজেলার ৭১টি ইউনিয়নের সংশ্লিষ্ট গ্রাম বিভিন্ন কারণে দর্শনীয়। এসব গ্রামে দেখার মতো এমন কিছু রয়েছে যা পর্যটন নগরী কক্সবাজারকে আরও সমৃদ্ধি করতে পারে। কিন্তু পর্যাপ্ত ‘পর্যটন ভিলেজ’ অর্থাৎ ‘পর্যটন গ্রাম’ হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় অভাবে কারণে তা মুখ থুবড়ে পড়েছে। পর্যটকদের সুবিধার্থে অনতিবিলম্বে এসব বিষয়গুলো নিয়ে জরুরি সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন।
সংকটাবস্থায় কক্সবাজার পর্যটন

আপনার মন্তব্য লিখুন